আওরঙ্গজেব কামাল : ভয়ংকর প্রতারণার তালিকায় আর এক নাম যুক্ত হলো মিল্টন সমাদ্দার। চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার (৪২) ভয়ংকর প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এরপর থেকেই মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। গত কয়েকদিন ধরে টক অব দ্য কান্ট্রি মিল্টন সমাদ্দার। তার বহু রকমের কাহিনিতে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি গণমাধ্যমও। মিল্টন সমাদ্দারের শুরুটা ছিলে ভাল। কিন্ত লোভ তাকে ভয়ংকর প্রতারকে পরিনত করেছে। মিল্টন একজন সাইকোপ্যাথ। তার মানবতার ফেরিওয়ালা হওয়া প্রতারনার কৌশল। মিল্টন সমাদ্দারের শুরুটা আন্তঃনগর বাসের হেল্পার হিসেবে। সেখান থেকে তিনি দাতব্য অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন। বিলাসবহুল গাড়ি, জমির মালিক হওয়ার পাশাপাশি সমাজসেবী হিসেবে হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ফেসবুকে ১৬ মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার নিয়ে বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন মিল্টন। তার মানবিক কাজকর্মের জন্য প্রশংসা কুড়ান। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মানবপাচার, কিডনি কেটে বিক্রি, রাতের আঁধারে মরদেহ দাফন ও টর্চার সেলসহ মৃত্যু সনদে জালিয়াতির মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। উক্ত অভিযোগ তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে তার দাতব্য সংস্থা চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৮৩৫ জন ব্যক্তির মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে আনা হয়েছে। এছাড়া মানব পাচারের অভিযোগও রয়েছে মিল্টনের বিরুদ্ধে। যার ফলে ঢাকার একটি আদালত নতুন করে তার চার দিনের রিমান্ড মজ্ঞুর করেন। মিল্টন সমাদ্দার ২০১৪ সালে মিরপুরের পাইকপাড়ায় গড়ে তোলেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’। সাভারেও তার আরেকটি আশ্রয়কেন্দ্র আছে। ভবঘুরে, পঙ্গু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আশ্রয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আর্থিক হিসাবে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি। মানুষের থেকে পাওয়া অনুদানের অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ‘বিপুল পরিমাণ’ টাকা ‘কোটি কোটি’ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। মানুষের কিডনি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিত্তবানদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তার গড়া আশ্রয়কেন্দ্রে অপারেশন থিয়েটার আছে। মিল্টন সমাদ্দার ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ। অসুস্থ আশ্রিতদের ছুরি-ব্লেড দিয়ে নিজেই হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতেন। রক্ত দেখে উল্লাস করতেন। ডাক্তারের কাছে নিতেন না। তার আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০০-৭০০ মানুষ আছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে আছে ৩০-৪০ জন।এত সংখ্যক আশ্রিতের তথ্য দিয়ে ভিডিও তৈরি করে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তার ফেসবুক পেজে ফলোয়ারের সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখ। তার ব্যাংক হিসাব ১০-১২টি। তার নিজের অ্যাকাউন্টে এখনো এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা আছে। লাশ দাফনের হিসাবে গড়মিল আছে। লাশ দাফন করতেন রাতের অন্ধকারে। ডাক্তারের নাম জালিয়াতি করে নিজেই মৃত্যু সনদ তৈরি করতেন।অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীনদের রাতে নিজেই লাঠি দিয়ে পেটাতেন। তার টর্চার সেল ছিল। আশেপাশের মানুষ প্রতিরাতে চিৎকার শুনতে পেতেন। এখন আমার প্রশ্ন এত সব অভিযোগ মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। তিনি ‘ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ’ এই তথ্য জানতে ১০ বছর সময় লাগল কেন? রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা ১০ বছরেও কিছু জানতে পারল না কেন ? এই ব্যর্থতার দায় কার। জন সাধারনের ক্ষতিপুরন কে দিবে? খোঁজ নিয়ে জানাযায়,এক সময় মিল্টন সমাদ্দার তার বাবাকে পেটালে এলাকাবাসী তাকে এলাকাছাড়া করে। সেখান থেকেই মূলত তার অপরাধের উত্থান হয়। পরে শাহবাগে এসে একটা ফার্মেসিতে চাকরি করেন। সেখান থেকে ওষুধ চুরি করার কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে মিটু হালদার নামে এক নার্সকে সে বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর তিনি একটা ‘ওল্ড অ্যান্ড কেয়ার’ স্থাপন করেন। তারপর সে তার স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এককথায় মিল্টন সমাদ্দার মানবতার মুখোশ পরে একজন ভয়ংকর অপরাধীর মতো দিনের পর দিন ভয়াবহ সব অপরাধ করে যাচ্ছিলেন। আমি মনে করি মিল্টন সমাদ্দার বর্তমানে একজন ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে আলোচনায় এসেছে । আমরা দেখেছি অনেক সময় মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কোনো কোনো মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয়। যেমন: ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেন প্রমুখ মহান স্বাধীনতার আদর্শে নিবেদিত হয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অপরাধ সমাজের অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য বিষয়। টি. এরিকসন বলেছেন, সন্ন্যাসীদের সমাজে বসবাসকারী সদস্যদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা বেশী লক্ষণীয়। মিল্টন সমাদ্দার ভদ্রতা ও মানবিকতার মুখোশ পরে অপরাধ করছিলেন। ডিএমপির ডিবিপ্রধান বলেন, মিল্টন সমাদ্দার ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। একটি-দুটি অপরাধ করেননি, তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তো ভয়াবহ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তার অ্যাকাউন্টে এখনো ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আছে। এত টাকা থাকার পরও তিনি কাউকে চিকিৎসা করাননি। যারা তার সঙ্গে জড়িত, যারা পেট্রোনাইজ করেছে, সহযোগিতা করেছে, ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য যারা পেট্রন করেছে, ফাউন্ডেশনের মেম্বার, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ৯০০ লোকের মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দার পুলিশকে জানিয়েছেন, আসলে ৯০০ মানুষ মরেনি। ১৩৫ জন মারা গেছে। তাদের দাফন করেছে। সেটারও তিনি রেজিস্টার্ড সংগ্রহে রাখেননি। এত মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে।ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগে তিন দিনের রিমান্ড শেষে গোয়েন্দারা তাকে আদালতে হাজির করলে ঢাকা মহানগর হাকিম শান্তা আক্তার এ আদেশ দেন। মিল্টন সমাদ্দারের জন্ম বরিশালের একটি গ্রামে। পরে মিরপুরের একটি ফার্মেসিতে বিক্রয়কর্মীর কাজ করতেন। এরপর ২০১৩ সালে মিরপুরে শিশু ও বয়স্কদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে প্রশংসা ও সম্পদের দেখা পান মিল্টন। মানবিক কাজের জন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।তবে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলোতে মিল্টনের কার্যকলাপের অন্যরকম চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণ মানুষের দান করা তহবিলের অপব্যবহার, তার তত্ত্বাবধানে থাকা মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং তার দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে অবৈধভাবে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে মিল্টনের বিরুদ্ধে। মিল্টন সমাদ্দারের পরিচিত স্থানীয় একটি মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেনের একটি অভিযোগে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। তোফাজ্জল বলেন, মিল্টনের আশ্রমে মারা যাওয়া কিছু ব্যক্তির মরদেহ গোসল করানোর সময় দেখা যায়, সবগুলোর শরীরে কাটা দাগ। এর জেরে আশপাশের স্থানীয় মসজিদে তার আশ্রমের মরদেহ দাফনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।দাতব্য তহবিলের অপব্যবহার: মিল্টনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে একটি সাততলা আশ্রম নির্মাণ। এর জন্য তিনি বড় অঙ্কের অনুদান ও জনসমর্থন পেয়েছিলেন। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মন্ডল জানান, ১৮ মাস ধরে প্রায় ৪৫.৪০ জমিজুড়ে নতুন আশ্রম নির্মাণের কাজ চলছে। মার্চ মাসে এর উদ্বোধন হয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, আশ্রমটি নির্মাণের জন্য সম্ভবত বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন হয়েছিল। নিকটবর্তী বাসিন্দা শামসুদ্দিন চৌধুরী জানান, নতুন আশ্রমের পাশে তার জমি আছে। শামসুদ্দিন দাবি করেন, মিল্টন ও তার সহযোগীরা পার্শ্ববর্তী রাস্তা দখল করেন এবং ১০ এপ্রিল তাকে হুমকি দেন। এর ফলে ১৫ এপ্রিল তিনি সাভার থানায় মামলা করেন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যমতে, মিল্টনের দুটি পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখনও ১.২৫ কোটি টাকা রয়েছে। এ তথ্যে দাতব্য কাজের জন্য আসা অনুদান কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন মিল্টন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে দাতব্য তহবিলের অর্থে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে আরও অনুদান আনার জন্য কবরের সংখ্যা বাড়িয়ে বলতেন। খোজ নিয়ে জানাযায়, মিল্টন বড় হয়েছেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নে। তার বড় ভাই লিটন সমাদ্দার এলাকায় বসবাস করেন। মিল্টনের বাবা জন সমাদ্দার অনেক আগেই মারা গেছেন। গুঠিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য স্বপন হালদার গ্রেফতার হওয়ার আগে মিল্টনের বিরুদ্ধে আনা অপকর্মের অভিযোগগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন না জানিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।এদিকে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় চার্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে মিল্টনের বিরোধ ছিল। স্থানীয়রা বলেন, ২০২০ সালে কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া আদেশ তৈরি করেন মিল্টন। এখন আমি বলবো আর যেন কোন মিল্টন সমাদ্দারের জন্ম না হয়। দেশের অসহায় মানুষের জন্য সরকারী তদরকী বাড়াতে হবে।