মোঃ সিরাজুল হক রাজু
স্টাফ রিপোর্টার।
বরিশালে সাম্প্রতিক কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে স্থানীয় তরুণ – কিশোরদের সম্পৃক্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মূলত দলবদ্ধভাবে তাদের এই অপকর্মে লিপ্ত হওয়াকে ‘গ্যাং’ কালচার (সংস্কৃতি) হিসেবে বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্টরা। সচেতন মহলের দাবি রাজনৈতিক পেশিশক্তি প্রদর্শনে এসব গ্যাং এর কদর বাড়ায় বিভিন্ন দলে যুক্ত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে স্থানীয় তরুণ – কিশোরেরা। তবে এই ‘গ্যাং’ সংস্কৃতির এখনই লাগাম টেনে ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হবার আহবান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে নগরীর রূপাতলী হাউজিং এলাকায় বসবাসরত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ২৫ জন আহত হয় এবং তাদের মধ্যে গুরুতর আহত ১১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হামলার ঘটনায় বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা এবং তাঁর পরিচালিত তরুণ গ্যাংদের যুক্ত থাকার তথ্য দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, গত ৩ মার্চ একই স্টাইলে কিন্তু স্বল্প পরিসরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মেসে (ভাড়া বাসা) হামলা চেষ্টা চালায় স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।নগরীর চৌমাথা করিম কুটির এলাকার এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
সেই অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে,ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আহমেদ মিলানের মেসে কিশোর সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা হামলা চেষ্টা করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী শাহবাজ মিঞা শোভন। এ ঘটনায় উপস্থিত জনতা ও পুলিশের হাতে আটক এক কিশোর শোভনকে হামলা চেষ্টার মদদদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শোভনকে শোকজ নোটিশ প্রদান করেছে।
অন্যদিকে, গত ৭ই মার্চ নগরীর সদর রোডস্থ বিখ্যাত টেইলরিং বিপণী বিতান ‘টপ টেন’ এ ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি চেষ্টা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী ইমরান শেখ নিশ্চিত করেন, এ ঘটনায় প্রায় ৪০-৫০ জনের তরুণ গ্যাং সদস্য অংশ নেয়। তবে এ ঘটনায় তৎক্ষনাৎ আটক পাঁচ যুবক নিজেদেরকে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিলেও বিষয়টি বিভ্রান্তিকর ও রহস্যজনক হিসেবে প্রতিয়মান হয়। পরদিন ৮ই মার্চ উক্ত কর্মচারী বাদী হয়ে নামধারী ও অজ্ঞাতনামা প্রায় ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
গভীর রাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ঘটনায় ১৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অমিত হাসান রক্তিম বলেন, ‘১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আমাদের ওপর হামলার ঘটনায় বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের একজন সহসভাপতি ও তাঁর তরুণ – কিশোর সহযোগীরাও যুক্ত ছিল। আহত একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, এই সকল সহযোগীরাই মূলত ধারালো অস্ত্রের দ্বারা আঘাত হেনেছে। কিন্তু জীবন রক্ষার ভয়ে এবং অভিভাবকদের চাপে এসকল দুর্বৃত্তদের নাম সামনে আনতে পারি নি আমরা ‘।
এদিকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তরুণ – যুবক গ্যাংদের ব্যবহারের সত্যতা পাওয়া যায় বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিনের কথায়। তিনি বলেন, ‘৭ই মার্চ নগরীর একটি বিপণী বিতানে ডাকাতি চেষ্টাকালে পুলিশের হাতে আটক তরুণেরা নিজেদেরকে আমার অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় তো দূরের কথা মহানগর ছাত্রলীগেরও কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আটক তরুণদের ছবি বর্তমানে ফেসবুকে ঘুরছে৷ মূলত আমাকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতেই পরিকল্পিতভাবে তরুণ গ্যাং দ্বারা এই ডাকাতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে ‘।
নগরী জুড়ে হঠাৎ গ্যাং সংস্কৃতি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের এমন আধিপত্য ভাবনায় ফেলেছে স্থানীয় সচেতন মহলকে। জাতীয়পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশালের সন্তান ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, ‘এটা সত্যি যে বরিশালে বড় বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড একসময় সাধারণ ঘটনা ছিল। তবে সেই সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছিল বর্তমান সরকার যখন ২০০৯ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসে এবং সাবেক সিটি কর্পোরেশন মেয়র শওকত হোসেন হিরনের জীবদ্দশায়। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সেই অন্ধকার ইতিহাসের পুনঃজাগরণের আলামত হিসেবে সামনে আসছে’।
এছাড়া সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘ সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে স্থানীয় তরুণ – কিশোরদের সংশ্লিষ্টতা আমাদের ভাবনায় ফেলেছে। মূলত রাজনৈতিক মদদে এসব কর্মকাণ্ডের পিছনে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর পেশিশক্তির চর্চা এবং পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতি। আমরা প্রত্যাশা করি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ দলে সন্ত্রাসী লালন পালনের চেয়ে আদর্শের চর্চাকে বৃদ্ধি করবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে’।
তবে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (হেডকোয়ার্টার্স) প্রলয় চিসিম বলেন, ‘ সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠিত ঘটনাগুলো নিয়ে আমরা সজাগ আছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি ঘটনায় একাধিক দোষীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বরিশালে কোন ধরণের গ্যাং কালচার যেন প্রতিষ্ঠিত না হয় সে ব্যাপারেও আমরা সচেতন রয়েছি ‘৷